Deprecated: str_replace(): Passing null to parameter #3 ($subject) of type array|string is deprecated in /home/metvbdco/public_html/common/config.php on line 148
নাসির যেভাবে সেরা অভিনেতা

|| মাটি এন্টারটেইনমেন্ট

প্রকাশিত: ১৫:০৩, ৬ নভেম্বর ২০২৩

বিভাগের পাঠকপ্রিয়

নাসির যেভাবে সেরা অভিনেতা

নাসির যেভাবে সেরা অভিনেতা

লাজুক হেসে নাসির উদ্দিন খান একবার কাঁচা–পাকা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমার জন্মটা হয়েছে ভুলে। মানে জন্মানোর কথা ছিল না। এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলতে পারেন।’

জানতে চাইলাম, এমন কথা কেন মনে হলো? তাঁর উত্তর, বাবাই বলতেন এটা।
 এরপর সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আপনি চট্টগ্রামের ভাষা বোঝেন?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই হেসে বললেন, ‘বাবা একবার তার এক বন্ধুকে আমাকে দেখিয়ে বলেছেন, “ইতে অইল আঁর হইলদা ঝাড়া ফোঁয়া, এনে ভুলে চলি আইচ্চে।’

চট্টগ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও হইলদা শব্দটি আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল।নাসিরই সাহায্য করলেন, ‘হইলদা মানে থলে। মানে থলে ঝাড়ার পর হঠাৎ একটা কিছু যেমন পড়ে যায়, তেমনি আমি পৃথিবীতে চলে এসেছি।’

বাবার ‘হইলদা ঝাড়া ফোঁয়া’ নাসির উদ্দিন খানকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এ দেশের বেশির ভাগ দর্শকের কাছে অ্যালেন স্বপন হিসেবে পরিচিত তিনি। ‘তাকদীর’, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ দিয়ে নিজেকে চেনানো এই অভিনেতা হাড়ে–মজ্জায় চাটগাঁইয়া। নিজেকে চাটগাঁইয়া হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্বও বোধ করেন।

আর সে কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার ২৮তম বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও দর্শকদের সঙ্গে বাতচিত করেছেন চাটগাঁইয়া ভাষায়। ইকবাল হোসাইন চৌধুরী পরিচালিত ‘বলী: দ্য রেসলার’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুবাদে সে দেশের দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। তবে নিজে স্বীকৃতি পাওয়ায় যতটা আনন্দিত তিনি, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন, চট্টগ্রামকে এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বিশ্বদরবারে হাজির করা গেল বলে।


এ বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী এই অভিনেতার সঙ্গে সম্প্রতি এক অন্তরঙ্গ আড্ডার সুযোগ হলো। বাবার ‘হাইলদা ঝারা ফোঁয়ার’ সেরা অভিনেতা হয়ে ওঠার কাহিনিটাও জানা গেল। আড্ডায় চট্টগ্রামের কথাই ঘুরেফিরে এল বারবার। এই শহরে নিজের বেড়ে ওঠার নানা চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। 

সোনা, রুপা, তামার চামচ
চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি এলাকার সমাদর কমিউনিটি সেন্টারের পাশে নাসির উদ্দিন খানের পৈতৃক বাড়ি। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে নাসির সবার ছোট। ‘ভুলে জন্ম নিলেও’ নাসিরের কথায় তিনি সোনা, রুপা, তামা যত রকমের চামচ আছে, সবই মুখে নিয়েই পৃথিবীতে এসেছেন। ব্যাপারটা কেমন? নাসিরের মুখ থেকেই শোনা যাক সে কথা।

পাঁচ ভাই এক বোনের বিশাল পরিবার তাঁদের। ভাইবোনদের মধ্যে নাসির সবার ছোট। বাবা মনু মিয়া ছিলেন কাজীর দেউড়ি এলাকার সরদার। তখন সরদারি একটা সম্মানজনক পদবি ছিল।

এখনকার কাউন্সিলরদের যেসব দায়িত্ব পালন করতে হয়, আগে সরদারেরা তাই করতেন। সরদারির পাশাপাশি বাবা ছোটখাটো চাকরি করতেন। নাসিরের কথায় সংসারে ভীষণ টানাটানি ছিল। তবে এসবের কিছুই দেখেননি তিনি। কারণ, তাঁর পিঠাপিঠি ভাইয়ের সঙ্গে বয়সের ব্যবধান ছিল ৯ বছর। অন্য ভাইদের সঙ্গে ব্যবধান আরও অনেক বেশি। সে কারণে নাসিরের যখন জন্ম, তখন ভাইয়েরা সবাই প্রায় বড় হয়ে গেছেন। ভাইয়েরা তখন চাকরি, টিউশনি, এটা–সেটা করে আয়ও করছেন। সংসারে সেই টানাটানিও আর ছিল না। সবার ছোট নাসির তখন হয়ে উঠলেন ভাইদের খেলনা বা খেলার পুতুলের মতো। সবাই যেন আদর ঢেলে দিলেন তাঁকে।
১৯৭৮ সালে বড় ভাইয়ের জন্য কনে যখন দেখতে গিয়েছিল বাড়ির সবাই, তখন কোনো একজন হবু ভাবির কোলে বসিয়ে দিয়েছিলেন নাসিরকে। সেই ভাবির কাছে পেয়েছিলেন মাতৃস্নেহ। অন্য ভাইদের স্ত্রীর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সবার স্নেহেই বড় হয়েছেন নাসির।

ভাইদের সঙ্গে আদর ও শাসনের সেই সম্পর্ক রয়ে গেছে এখনো নাসিরের। চট্টগ্রামের কোথাও আড্ডায় রাত ১০টা পার হলেই ভাইয়েরা ফোন করেন তাঁকে। এত দেরি হচ্ছে কেন, জানতে চান। ভুলেই যান নাসির এখনো ছোটটি নেই।

২০০১ সালে বিয়ে হয় নাসির উদ্দিন খানের। স্ত্রী নাসরিন আক্তারসহ নিজেদের কাজীর দেউড়ির তিনতলা বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে নতুন সংসার শুরু হয় তখন। তবে সে সময় বেশ টানাটানি ছিল নাসিরের। পদোন্নতি না হওয়ায় বেতনও বাড়ছিল না। ভাইয়েরা তখন নাসিরকে তাঁদের সঙ্গেই খেতে বললেন। বছরখানেক এক ভাইয়ের বাসায় খেয়েছেন। এভাবে সব সময় ভাইয়েরা কাছে থেকেছেন তাঁর।

যেভাবে নাটকে
নাটকের প্রতি নাসিরের ভালোবাসা শৈশবেই তৈরি হয়। সেন্ট মেরিস স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল ফাংশনে প্রথম মঞ্চে নাটক করেন। এরপর ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে আরও একবার এবং একাদশ শ্রেণিতে উঠে তৃতীয়বার স্কুল ফাংশনের নাটকে অভিনয় করেন তিনি। স্কুলে থাকার সময় মঞ্চের এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে নাটকের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। পরে ১৯৯৫ সালে যোগ দেন তির্যক নাট্যগোষ্ঠীতে। তির্যকে যোগ দেওয়াটা তাঁর জীবনের একটি বাঁক বদলের মতো। এই সিদ্ধান্তই তাঁর জীবন আমূল বদলে দিল। পরবর্তী জীবনে তাঁর ধ্যান–জ্ঞান, নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়ায় অভিনয়।

নাসির উদ্দিন খান
নাসির উদ্দিন খানপ্রথম আলো
নাটকের কারণে অন্য পেশায়ও থিতু হতে পারেননি নাসির। ভাইদের মধ্যে তৃতীয় আমানুল্লাহ খান আবুর সঙ্গে নাসিরের ঘনিষ্ঠতা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাঁর আগ্রহে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি (সিএ) পড়া শুরু করেছিলেন। সিএ কোর্স শেষ করে ২০০০ সালের দিকে চট্টগ্রামের একটি ফার্মেও যোগ দিলেন। কিন্তু সেখানে কাজে মন বসছিল না।

পদোন্নতি কিংবা আয়–উন্নতি কোনোটাই নেই। কেনই–বা থাকবে। নাসিরের কথায়, কাজে তাঁর একদম ফোকাস ছিল না। অফিসে এসেও নাটকপাড়ায় মন পড়ে থাকত। অফিসের ছাদে চলে যেতেন একা একা রিহার্সাল করতে। ২০১৫ সালের দিকে তাঁর এমন অবস্থা দেখে কোম্পানি জানাল, এবার থেকে অর্ধেক বেতন দেওয়া হবে তাঁকে। চাকরি থেকে নাসিরেরও মন উঠে গেছে তত দিনে। ভাবলেন, অনেক হয়েছে। সে বছরই ইস্তফা দিলেন চাকরিতে। ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের পাট চুকিয়ে পাড়ি দিলেন ঢাকায়। মেয়ে নাদিরা তখন প্রাথমিক শেষ করে উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ছেলে নূরাজ আরও ছোট। ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীকে চট্টগ্রামে রেখে ঢাকায় এক অনিশ্চিত জীবন শুরু করলেন নাসির। বন্ধু ও নির্মাতা হাবীব শাকিলের মোহম্মদপুরের বাসায় গিয়ে উঠলেন। পাঁচটি মঞ্চনাটকের শতাধিক প্রদর্শনী, পথনাটক, বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য ও ‘আলগা নোঙর’ নামের পূর্ণদৈর্ঘের একটি চলচ্চিত্রে অভিয়নের অভিজ্ঞতা সঙ্গে করে ঢাকায় এলেন তিনি। ঢাকায় এসে ‘তাকদীর’, ‘মহানগর’, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’–এর মতো ওটিটি সিরিজে অভিনয়ের সুযোগও পেয়ে যান। এরপরের কাহিনি সবার জানা।

খাঁটি চাটগাঁইয়া
নাসির নিজেকে খাঁটি চাঁটগাই বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন। চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকার শিল্প–সাহিত্যের আড্ডায় প্রায় দেখা যায় তাঁকে। তবে সেখানে তিনি অ্যালেন স্বপন নন। সবার প্রিয় নাসির ভাই। তালেবের চায়ের দোকানে দই–চিড়া আর রং চা খেতে খেতে আড্ডা জমান তিনি। প্রাণবন্ত আড্ডায় হাসির ফোয়ারা ছোটে। চাটগাঁইয়া মৌতাতে কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

চট্টগ্রামের নাগরিকতায় একটা অনন্য ব্যাপার আছে। নাসিরের কাছে সেটা খুবই উপভোগ্য। নাসির বলেন, পাহাড়, নদী আর সাগরের কারণে এখানকার মানুষ খুবই উদার, সহিষ্ণু ও কৌতুকপ্রিয়। এখানকার মানুষজনের মধ্যে একটা ‘ড্যামকেয়ার’ ভাব আছে। তাঁরা সব সময় ‘বিন্দাস’ থাকতে চান।

মাটির কাছাকাছি
বড় তারকা হিসেবে নাম করার পরও নাসিরের চালচলনে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। সাধারণ বেশভূষায় চলাফেরা করেন। সব মিলিয়ে ভীষণ বিনয়ী তিনি। এর কারণ জানতে চাইলে নাসির পাল্টা প্রশ্ন করেন, সেটাই তো স্বাভাবিক, তা–ই না? তা ছাড়া তির্যকে যোগ দিয়ে যা কিছু শিখেছি, তা এখনো ভোলেননি তিনি। তির্যকের মহড়াকক্ষে ঢুকতে হতো জুতা খুলে। তাই অভিনয় যে একটা পবিত্র বিষয়, সেটা তখন থেকেই মাথায় ঢুকে গেছে। বিনয়ী হওয়ার শিক্ষাও সেখানে পেয়েছেন।
১৯৯৬–৯৭ সালের দিকে ‘তীর্থযাত্রা’ নামের তির্যকের একটি নাটকে তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। এই নাটকে অভিনয়ের সুবাদে অনেক প্রশংসাও পান। তখন একটু যেন অহংকারও এসে গিয়েছিল। ‘কলার উঁচু করে’ হাঁটতেন। নাটকের রিহার্সালেও প্রায় দেরি করে আসতেন। তখন তির্যকের নির্দেশক সালাউদ্দীন ভূঁইয়া একবার তাঁকে ডেকে সবার সামনে অনেক কঠিন কথা বললেন। সেসব কথা হজম করা সে বয়সে খুব সহজ কাজ ছিল না। শিল্পকলা একাডেমি থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন কাঁদতে কাঁদতে। এর পর থেকে আর কখনো ‘মাটিতে পা না পড়ার’ মতো মনোভাব হয়নি তাঁর।

চরিত্রের ভেতরে বসবাস
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বা সিনেমায় একটা নতুন চরিত্রে কাজ শুরু করার আগে অনেক সময় নেন নাসির। প্রথমে স্ক্রিপ্ট পড়ে পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করে চরিত্রটা বুঝে নেন। 

তারপর ধীরে ধীরে সেই চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকেন। অনেক সময় পাঁচ–ছয় মাস ধরে চলে প্রস্তুতি। চরিত্রটির মতো করে জীবন যাপন করতে থাকেন। ভাবতে থাকেন সেই চরিত্রের মতো করে। ফলে শুটিং শুরুর অনেক আগে থেকেই নাসিরের কাজ শুরু হয়ে যায়।

নাসিরের এই কাজের ধরনের কারণে অভিনয় নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকা হয় না। বরং যা করেন, তা সময় নিয়ে, নিখুঁতভাবে করেন। এ জন্য অন্যান্য অভিনেতার চেয়ে তাঁর ব্যস্ততাও কম।

কম কাজ করার আর্থিক ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেন নাসির? এমন প্রশ্নে তিনি খানিকটা অবাকই হন। বলেন, ‘ক্ষতি কেন হবে। আপনি ধরেন, একখানা গাড়ির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তা হলে সে জন্য বাড়তি আয় করার চাপও নিতে হবে আপনাকে। সে চাপ নিতে রাজি নই আমি। পরিবার, বন্ধু, বই আর নাটক নিয়ে অর্থপূর্ণ একটা জীবন কাটাতে পারলে এসবের কিবা প্রয়োজন?’ একগাল হেসে পাল্টা প্রশ্ন করেন এই সময়ের সেরা অভিনেতা নাসির উদ্দিন খান।